ভারত থেকে পনেরো দিনের লম্বা ছুটি কাটিয়ে সদ্য দেশে ফিরেছি। কিছুটা ঢিলেঢালাভাবে অফিসে ঢুকতেই আমাদের বস, এ বছরের শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাতার পুরস্কারপ্রাপ্ত সাদাত হোসাইন ভাইয়া বললেন, “চল, এখুনি যেতে হবে”। কোথায় যাচ্ছি বা কী করতে যাচ্ছি সেসব প্রশ্ন করার ফুরসতও পেলাম না। অফিস থেকে বেরুবার পর গন্তব্যের পথে রিক্সায় বসে জানতে পারলাম যে আমরা সৈয়দ আব্দুল হাদীর ওপর একটি ডকুমেন্টারি নির্মাণের কন্ট্রাক্ট পেয়েছি। এখন তাঁর বাসায় যাচ্ছি শ্যুটিং করতে। আমার সরল প্রশ্ন, “কোন সৈয়দ আব্দুল হাদী?” আমাকে চমকে দিয়ে সাদাত ভাই বললেন, “কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী সৈয়দ আব্দুল হাদী।” এরপরে ডকুমেন্টারিটা কেমন হবে, তাতে ঠিক কী কী থাকবে এই বিষয়ে বিস্তর আউটলাইন সাদাত ভাই রিক্সায় বসেই বর্ণনা করছিলেন। কিন্তু তাঁর কোন কথাই আমার কানে যাচ্ছিলো না। রিক্সায় বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি কেবলই সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলাম। উনি আমাকে সৈয়দ আব্দুল হাদী’র মতো একজন কন্ঠশিল্পীকে সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য করে দিচ্ছেন বলে। রিক্সার পথটুকু শেষ হচ্ছে না কেন বড্ডে উত্তেজনা বোধ করছিলাম। আমার এমন পাগলামি ভরা উত্তেজনা ভীষণ উপভোগ করছিলেন ASH Production এর কর্ণধার সাদাত হোসাইন। স্নেহ আর প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলছিলেন, “তুই একটু শান্ত হয়ে বস তো।” কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও আমি শান্ত হয়ে বসতে পারছিলাম না।
স্বপ্ন দেখছি নাকি সত্যি, সেটা বুঝে ওঠার আগেই পৌঁছে গেলাম হাদী স্যারের বাসায়। নিজেই দরজা খুলে দিলেন। মাত্র একহাত দূরত্ব থেকে এই কিংবদন্তিকে দেখছি আমি! আমার হাত পা কাঁপছে। সাদাত ভাইয়া সালাম করলেন। সম্বিত ফিরে পেলাম। আমি নিজেও উনাকে সালাম করলাম। ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে গেছেন ASH এর আরেকজন চীফ এসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর মাঈন এবং সিনেমাটোগ্রাফার সোহাগ ভাই। দরাজ কন্ঠে হাদী ভাই বললেন “তোমরা কিছুক্ষণ বসো। আরেকজন গেস্ট আছে। উনাকে একটু সময় দিয়েই তোমাদের সাথে বসছি।”
অপেক্ষমান থাকা অবস্থাতে আমি বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলাম। আমার কৌতুহল বরাবরই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি। গেস্টরুম থেকে দরাজ কন্ঠে গান ভেসে আসতে লাগলো। কেবল একটা হারমোনিয়ামে গাওয়া গান। আহা, তাতে কত সুর! কত আবেগ! মুগ্ধতায় ততক্ষণে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছি। এর মাঝেই খেয়াল করলাম হাদী ভাই রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছেন। আমিও উঁকি দিলাম। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে গেস্টদের জন্য উনি নিজহাতে চা বানাচ্ছেন। আমি সাহায্য করতে এগিয়ে গেলাম। কিন্তু উনি নিজেই চা বানালেন। তার পরেই গেস্ট চলে গেল। পরে জানতে পেরেলাম, তরুণ যে অতিথি উনার কাছে এসেছিলেন, দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি ক্যান্সারের পেশেন্ট। হাদী ভাইয়ের ভক্ত। হাদী ভাইকে নিজ চোখে দেখার সখ ছিল তাঁর। কিন্তু হাদী ভাইয়ের কাছে আসার আগ মুহূর্তেও তিনি হয়তো জানতেন না যে তিনি পরম মমতায় চা বানিয়ে খাওয়াবেন। আমি যে এই ঘটনা আজকে এখানে লিখলাম, সেটা জানতে পারলেও ভীষণ রাগ করবেন হাদী ভাই। কারণ ভক্তদের প্রতি পরম মমতার এই অসম্ভব সুন্দর ঘটনাটি আমরা ডকুমেন্টারিতেও উল্লেখ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু নিজের প্রশংসার ব্যাপারে ভীষণ কৃপণ এই চমৎকার ব্যক্তি। তবুও এই অনন্য সুন্দর ঘটনাটা লেখার লোভ কিছুতেই সামলাতে পারলাম না। ভুল হয়ে থাকলে ক্ষমা করবেন হাদী ভাই।
এবারে আমাদের শুটিং এর পালা। লাইট অন হলো, ক্যামেরা অন হলো। সিনেমাটোগ্রাফার সোহাগ ভাই বললেন, “রোলিং!” সাদাত ভাইয়ের, “অ্যাকশন!” সেই শুরু। তারপর থেকে শুটিং চলতেই থাকলো। হাদী ভাইয়ের বাসায় এবং রেকর্ডিং স্টুডিওতে। ইনডোরে এবং আউটডোরে, দিনে এবং রাতে। বিস্মিত হয়ে দেখতে লাগলাম হাদী ভাইয়ের ধৈর্য্য। আর দক্ষ নির্মাতা সাদাত হোসাইনের ডিরেকশন। মনভরে শিখতে লাগলাম আর্ট। একবার হাদী ভাইয়ের কাছ থেকে শিখি। আরেকবার সাদাত ভাইয়ের কাছ থেকে শিখি। শিখি জীবনবোধ, বিনয়, অভিজ্ঞতা, নিয়ম, নীতি, আদর্শ, আর আকাশকে ছুঁয়ে দেবার কৌশল। সাদাত ভাই গল্পের মত করে প্রশ্ন করেন, আর হাদী ভাই দৃশ্যায়নের মত করে উত্তর দেন। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনি। জীবনের গল্প শুনি, গানের গল্প শুনি। শুনি ছেলেবেলার গল্প। বেড়ে ওঠার গল্প। স্বপ্নের গল্প। পরিবারের গল্প। শিল্পী হয়ে ওঠার গল্প। মুগ্ধ হয়ে উনার এসব গল্প শুনি আর সাদাত ভাইয়ের নির্দেশে কাগজে নোট করে রাখি যে এর মধ্যে কোন কোন গল্প আমরা ডকুমেন্টারিতে তুলে ধরবো। মুগ্ধ হয়ে উনার গল্প শুনি আর ইন্টারভিউ রেকর্ডের জন্য ব্যুম ধরে থাকি। কখনো কখনো সোহাগ ভাইকে ক্যামেরার লেন্স বদলে দেই। একের পর এক ‘রোলিং-অ্যাকশন আর কাট’ হয়। একের পর এক লেন্স বদল হয়। গল্প এগিয়ে চলে। একটি কিংবদন্তির জীবনের গল্প। দিনভর শুটিং একটা সময়ে শেষ হয়। শরীর ভেঙ্গে আসে ক্লান্তিতে। আবারও পরবর্তী সেশনের অপেক্ষায় থাকি।

অপেক্ষা শেষ হয়। এবারে হাদী ভাইয়ের দেশের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যাবার পালা। পুরো এ্যাশ টিমে একটা উৎসব উৎসব ভাব। তুমুল আনন্দ। শুটিং এর আনন্দ। বেড়াতে যাবার আনন্দ। হাদী ভাই আর এ্যাশ টিমকে নিয়ে দুটো মাইক্রোবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। আমাদের সাথে আছে ‘ইবিএস’ তথা ‘বাংলাঢোল’ এর প্রধান এনাম ভাইও। ‘বাংলাঢোল’ই হাদী ভাইয়ের এই ডকুমেন্টারিটা প্রযোজনা করছে। বাংলা সংস্কৃতির স্বকীয়তা রক্ষায় ‘বাংলাঢোল’ যেন সাহসী যোদ্ধা। এই সফরে আমাদের সাথে আরও আছেন হাদী ভাইয়ের পাঁচজন স্কুলের বন্ধু। সবারই বয়স পঁচাত্তর পেরিয়েছে। কিন্তু মনের দিক থেকে প্রত্যেকেই যেন টগবগে তরুণ। হাদী ভাইয়ের স্কুলের এই বন্ধুরাও প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একেকজন কর্তাব্যক্তি। শুটিং এর ফাঁকে ফাঁকে আনন্দ চলছে নাকি হাসি-আনন্দ আর গানের ফাঁকে ফাঁকে শুটিং চলছে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না। শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, যে সময়টুকু আনন্দ হচ্ছে তখন ভীষণ আনন্দ হচ্ছে। আবার যেই সময়টুকু শুটিং চলছে, তখন আমরা চমৎকার সব ফুটেজ পাচ্ছি। একজন ‘প্রধান সহকারী পরিচালক’কে শুটিং চলাকালীন সময়ে ফুটেজ দিয়ে তৃপ্ত করতে পারা খুব একটা সহজ কাজ নয়। কিন্তু প্রায় প্রতিটা শট শেষেই ভীষণ তৃপ্ত হচ্ছি আমি আর মাঈন। হাদী ভাই, হাদী ভাইয়ের বন্ধুরা, সিনেমাটোগ্রাফার সোহাগ ভাই আর বলাই বাহুল্য এই ডকুমেন্টারির পরিচালক সাদাত ভাই প্রত্যেকেই নিজ নিজ দক্ষতার জাদু দেখাচ্ছেন। হাদী ভাইয়ের স্কুলে শুট হলো, নদীর পাড়ে শুট হলো, হলো নৌকায়। দেখতে দেখতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ট্যুরের প্রথম দিনটা শেষ হয়ে গেল। দ্বিতীয় দিন আমরা হাদী ভাইয়ের মামার বাড়িতে শ্যুট করলাম। যেই বাড়িতে হাদী ভাইয়ের শৈশবের অনেকটা সময় কেটেছে, সেই বাড়ি। বুঝতে পারলাম যে, পারিবারিক জীবনেও ভীষণ জনপ্রিয় নাম, সৈয়দ আব্দুল হাদী। তাঁর মামী এখনও জীবিত। হাদী ভাইয়ের মামী তাঁকে ছোট্ট শিশুর মতন আদর করলেন। কোন কোন জায়গায় আসলে মানুষ আজীবন শিশুই থেকে যায়। কোথাও কোথাও মানুষের বয়স বাড়ে না, বাড়ার নিয়ম নেই। শুটিং শেষ করে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে আমরা ফিরতি পথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। পথিমধ্যে একট��� লটকনের বাগানে নেমে বাগানের মালিকের অনুমতি নিয়ে সবাই মিলে হইচই করে খুব আনন্দ করে লটকন খেলাম। সব কিছুতেই আমাদের সঙ্গ দিলেন বাংলা সঙ্গীতের জীবন্ত মহীরুহ সৈয়দ আব্দুল হাদী।
ডকুমেন্টারির শুটিং প্রায় শেষ পর্যায়ে। শুটিং শুরুর আগে হাদী ভাইকে স্রেফ একজন সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে চিনতাম। কিংবদন্তী সঙ্গীত শিল্পী। শুটিং শুরু হতে না হতেই উনাকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে চিনতে শুরু করলাম। ক্রমশ তাঁর কাছাকাছি যতটুকু সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি, একটু একটু করে নতুন নতুন সব পরিচয় পেয়েছি। একজন মানুষের জ্ঞানের গভীরতা কত বেশি হতে পারে, তা হাদী ভাইকে না দেখলে বলে বোঝানো সম্ভব না। ভীষণ পড়ুয়া এই মানুষটি শুধুমাত্র সঙ্গীত জীবনেই নয়, পড়ালেখা, চাকুরী জীবন, পারিবারিক জীবন এবং বন্ধুমহলসহ সবখানেই সমানভাবে মহীরুহতুল্য। আমার মধ্যে সর্বশেষ মুগ্ধতাটা ছড়িয়েছেন তাঁর একাগ্রতা দিয়ে। এই বয়সেও গ্রীষ্মকালে অনেকটা সময় ইলেকট্রিক ফ্যান ছাড়া তীব্র লাইটের মাঝে শুটিং করেছেন বিনা অভিযোগে। শুটিং পুরোটুকু শেষ হবার পরে হাদী ভাই নিজেই একদিন সাদাত ভাইকে ডেকে বললেন, “চলো না, একটু গ্রামের দিকে গিয়ে আরও কিছু ফুটেজ নিয়ে আসি।” যেকোন সৃষ্টিকেই পার্ফেক্ট করে তুলতে উনার এই ডেডিকেশন মুগ্ধতায় ভাসিয়েছিলো আমাদের গোটা টীমকে। হাদী ভাই এর সাথে পুরোটা সময় আমার কাছে ছিল একটি শিক্ষাসফরের মত। স্বপ্নের চেয়েও সুন্দর আজীবনের রসদ জোগানিয়া একটা শিক্ষাসফর।
শুটিং এর জন্য বেশ অনেকগুলো দিন পারস্পরিক সংস্পর্শে থেকে হাদী ভাইকে আমি চিনলাম জীবনযাপনের উদাহরণ হিসেবে। জ্ঞান, শিক্ষা, মহত্ব এবং আরও অনেক ‘সু’ বিশেষণের প্রতীক হিসেবে। অথচ হাদী ভাই আমাকে চিনলেন পেটুক হিসেবে। গুণী মানুষের চোখ কি আর ফাঁকি দেয়া যায়! আমিও তাঁর চোখকে ফাঁকি দিতে পারলাম না। শুটিং এর প্রথম দিনগুলোতে তাঁর বাসায় গেলেই আমাদের অমৃততুল্য এক ধরনের বিস্কুট খেতে দিতেন। আমি সেই বিস্কুটের প্রেমে পড়েছিলাম। এক হাতে ভয়েস রেকর্ডার ধরে থেকেই অন্য হাতে কচকচ করে বিস্কুট খেয়ে পুরো বাটি শেষ করে ফেলতাম নিমিষেই। আমাকে প্রবল মমতায় আবারও বিস্কুট এনে দিতেন। সেই বিস্কুট শেষ হতে আমার লাগত মাত্র পাঁচ মিনিট। তাঁর মধ্যে চার মিনিটই যেত বিনয়ে ‘আহা, কী প্রয়োজন ছিল’ বলতে বলতে। শুটিং শেষ হবার পর ‘আবার যে কবে হাদী ভাইয়ের বাসায় আসা হবে’ অথবা ‘আদৌ কি আর কোন দিন আসা হবে কি না’-এই ভেবে আমার যে মন খারাপটা হতো, তাঁর পেছনে এই বিস্কুটের অবদান কি একটুও নেই? কে জানে! আছে হয়তো!!
লেখক : নাঈম অঙ্কন, চলচ্চিত্র নির্মাতা ও লেখক
ছবি : খান সোহাগ, সাদাত হোসাইন