আমেরিকান বিউটি সিনেমার গোলাপের পাপড়ি কিংবা শশাঙ্ক রিডেম্পশান এর কল্পনার বিহঙ্গ কিংবা দ্য প্রফেশনাল এ লিওনের ভালোবাসার ঘরোয়া বাগানের কথা চিন্তা করুন। এসব সিনেমার রূপক বা মেটাফোরগুলো সিনেমা শেষ হয়ে যাবার পরেও সবার মাঝে অনুভূত হতে থাকে। তৌকির আহমেদ পরিচালিত ‘হালদা’ সিনেমাটিও ঠিক তেমনভাবে ভালোলাগার কারণ হয়ে থাকবে এই মেটাফোরের কারণে। কিভাবে? বিষয়টি বিশ্লেষণ করতে গেলে একটু গল্প করি চলুন।
তৌকির আহমেদের ‘হালদা’ দৃশ্যায়নের সাথে সাথে মূল গল্পটি ধরে রেখে সামনের দিয়ে এগিয়েছে সিনেমার চরিত্রগুলোকে সাথে নিয়ে। চরিত্রগুলোকে আলাদাভাবে স্পেস দিয়ে গল্পের জাল বুনে গ্রামীণ জনপদের কথা তুলে ধরার চেষ্টা করে গেছেন পরিচালক। চরিত্র, দৃশ্যায়ন কিংবা শব্দ এগুলোর আলোচনা পরে হোক। আসুন ‘হালদা’ আসলে কেমন চলচ্চিত্র তা জেনে নেওয়া যাক।
‘হালদা’ একটি মেটাফোরিক সিনেমা। মেটাফোর সিনেমাকে বিশ্লেষণ করতে গেলে গল্পের উপরের কথাগুলো পাশাপাশি চলে আসে, এজন্য আগে থেকেই কিছু কথা বলে নেওয়া। আসলে মেটাফোর সিনেমাতে মূলত দৃশ্যায়নের মাধ্যমে সিনেমার ভাব উপস্থাপন করা হয়ে থাকে। সিনেমাতে মূলত দু ধরনের মেটাফোর স্ক্রিনপ্লেতে ব্যবহার করা যায়ঃ
– স্ট্যাটিক বা স্থির
– ডায়নামিক বা প্রগতিশীল
অনেকেই বলতে পারেন হালদা নিয়ে রিভিউ লেখার জন্য এসব কথা কেন আসছে? কেন আসছে সে কথা না হয় পরে বলছি। আগে প্রকারভেদগুলো একটু সংক্ষেপে আলোচনা করি চলুন।
স্ট্যাটিক মেটাফোর হল কোন বিষয়বস্তুকে স্থির রেখে কাহিনী এগিয়ে নেওয়া হয়। মূলত একটি চরিত্রের উপর ফোকাস করে সিনেমাটি করা হয়। যখন একটি সিনেমা স্ট্যাটিক মেটাফোরের উপর ভিত্তি করে নির্মান করা হয় তখন সিনেমার বিন্যাস অনেক সরল হয়, গল্পের মাঝে তেমন কোন জট থাকে না। স্ট্যাটিক মেটাফোর এর উপর নির্মিত সিনেমার ক্ষেত্রে ড্রামাটিক উপাদান খুব থাকে। অনেক ক্ষেত্রে সিনেমাটি বোরিং হয়ে যেতে পারে।
অন্যদিকে ডায়নামিক বা প্রগতিশীল মেটাফোরের ক্ষেত্রে সিনেমার প্রধান বিষয়বস্তু একাধিক হতে পারে। সিনেমার প্লট ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তিত হয়। সিনেমার একটি শুরু থাকে, ক্লাইম্যাক্স থাকে, এন্ডিং থাকে। একটি চরিত্র অন্য চরিত্রের সাথে জড়িত থাকে, কখনো অন্য চরিত্রটি প্রধান চরিত্রের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ ধরনের সিনেমার ক্ষেত্রে ড্রামাটিক উপাদান খুব বেশি থাকে। বলা যায় মূল বানিজ্যিক সিনেমার বেশিরভাগই ডায়নামিক মেটাফোরের উপর করা হয়ে থাকে।
এখন বলতে পারেন এতো কথা কেন বললাম? উপরের আলোচনা যদি একটু ভালোভাবে পর্যালোচনা করেন তাহলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন ‘হালদা’ একটি স্ট্যাটিক মেটাফোরের উপর ভিত্তি করে নির্মিত সিনেমা। ‘হালদা’ সিনেমাতে নদী এবং নারীর মধ্যে এক আত্নিক মিল রয়েছে। নদী যেভাবে মানুষের দ্বারা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে, দূষণের শিকার হচ্ছে ঠিক সেভাবে আমাদের সমাজে নারীও প্রতিনিয়ত অত্যাচারিত হচ্ছে। হয়তো কখনো প্রকাশ্যে, কখনো বা চার দেয়ালের ভিতরে। নুসরাত ইমরোজ তিশার ‘হাসু’ চরিত্রটিকে রূপকভাবে দেখানোর মধ্য দিয়ে পরিচালক নদীর উপর অত্যাচারের কথাটি ফুটিয়ে তুলেছেন। ‘হাসু’ই সিনেমার প্রধান চরিত্র।
আপনি যদি স্ট্যাটিক মেটাফোরের আলোচনার দিকে খেয়াল করেন তাহলে দেখতে পারবেন নদীর বিষয়টিকে ফোকাস করে ‘হালদা’র গল্প এগিয়েছে খুব সরলভাবে। অন্য চরিত্রগুলো এসেছে গল্পের প্রয়োজনে, কিন্তু কখনো সেভাবে প্রধান্য বিস্তার করতে পারেনি হাসু চরিত্রের কাছে। যখনই চেষ্টা করেছে তখনই হাসু চরিত্রটি নিজের প্রতিবাদী রূপে হাজির হয়েছে, কখনো কাজের লোককে চপেটাঘাতের মধ্যে দিয়ে, কখনোবা মাছের প্লেট ফেলে দেবার মধ্য দিয়ে। ‘হাসু’ চরিত্রটি যে সিনেমার প্রধান চরিত্র তা কিন্তু সিনেমার পোস্টার দেখলেই বোঝা যায়। সিনেমার প্রতিটি পোস্টারে নুসরাত ইমরোজ তিশা অর্থাৎ হাসুকে ফোকাসে রাখা হয়েছে। স্ট্যাটিক মেটাফোরিক সিনেমার পোস্টার নিয়ে একটি সুন্দর লাইন আছে-
“Static metaphors featured on movie posters, metaphors arrest us, instantly messaging a story idea in a single image.”
চলুন এবার একটু সিনেমার অন্য উপদানগুলোর দিকে নজর দেওয়া যায়। সিনেমার কালাকুশলীদের অভিনয়, দৃশ্যায়ন, মিউজিক, ভিজুয়্যাল ইফেক্ট, কালার গ্রেডিং নিয়ে একটু কথা দরকার।
অভিনয়ের দিক থেকে বলা যায় সবাই খুবই ভালো অভিনয়শিল্পী। তবে গল্পটি এগিয়ে নেওয়ার জন্য হয়তো কাউকে কম স্পেস দেওয়া হয়েছে, কাউকে বেশি। ‘হাসু’ চরিত্রে নুসরার ইমরোজ তিশা অসাধারনের থেকেও বেশি ভালো অভিনয় করেছেন। ‘নাদের’ চরিত্রে যেন অন্য এক জাহিদ হাসানকে দেখলাম। এতোদিন আরমান ভাই নামে যে জাহিদ হাসানকে মানুষ চিনত তিনি পুরোপুরো সে ধ্যানধারনা পাল্টে দিয়েছেন। আমার কাছে হালদার বেস্ট অভিনয় জাহিদ হাসানের নাদের চরিত্রটি। এছাড়া মোশাররফ করিম, ফজলুল রহমান বাবু এবং রুনা খানও বেশ ভালো করছেন।
আলাদা করে একজন মানুষের কথা বলতে হয়- দিলারা জামান। যুগ-যুগান্তর ধরে চলে আসা অসহায় গ্রামীণ নারী সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি এ সিনেমাতে। হাজার বছর ধরে যে নারী সমাজ পুরুষদ্বারা শাসিত হতে হতে নিজের পরিচয় ভুলে যায়, তা দিলারা জামানের চরিত্রের মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে। একজন মেয়ে বিয়ের পর স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হবে, এটা যদি হয় বংশের পরম্পরা তা হলে সে ধরনের সমাজকে ধিক্কার দেওয়া উচিত। জীবনের বেশিরভাগ সময় স্বামীর ভিটাতে থাকতে থাকতে নিজের নাম যখন কেউ নেয় না তখন মনের ভিতরের আক্ষেপ যে কষ্ট এবং যন্ত্রণায় পরিনত হয় তা ‘সুরত বানু’ নামটির মধ্য দিয়ে ফুটে এসেছে। সিনেমার সেরা দৃশ্য এবং সংলাপ বলা যায়, “হাসুর মুখে সুরত বানু”।
সিনেমার কালার গ্রেডিং ভালো ছিল, বজ্রপাতের ইফেক্টগুলো বেশ ভালো ছিল, তবে কিছু বৃষ্টির দৃশ্য ছিল সেখানে ইফেক্ট দিয়ে বৃষ্টি আনা হয়েছে কিন্তু নদীর পানিতে বৃষ্টির ফোটা পতন ছিল না। এটা কারো কারো কাছে চোখে লাগতে পারে। মিউজিক ছিল দারুণ। ‘প্রেমের আগুন’ গানটি আমার ব্যাক্তিগতভাবে খুবই প্রিয়। পিন্টু ঘোষ আসলেই ভালো কাজ করেছেন-এ কথা বলতেই হবে।
মেটাফোর সিনেমার জন্য যে ধরনের দৃশ্যায়ন প্রয়োজন ঠিক সে ধরনের দৃশ্যায়নই দেখতে পাওয়া গেছে। নদীর সাথে সাথে মানুষের মনটাও যে কতটা দূষিত হয়েছে তা ইটের ভাটার কালো ধোঁয়ার দৃশ্য দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিচালক।
সিনেমার মধ্যে দিয়ে পরিচালক তৌকির আহমেদ একটি ম্যাসেজ দিতে চেয়েছেন যে, নদীকে যতই অত্যচার করা হোক, সে একদিন তোমার সব অত্যচার ফিরিয়ে দিবে। এজন্য তিনি বারবার ফিরে গিয়েছেন নদী, নদী রক্ষা আন্দোলন, সরকারি হস্তক্ষেপের দিকে। বলা যায় আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থাকেও একটু স্যাটায়ার করেছেন নদীকে উপজীব্য করে। তবে স্ট্যাটিক মেটারফোরকে ঠিক রেখেও তিনি চেয়েছেন সিনেমাটিকে একটু ড্রামাটিক করতে, এজন্য হয়তো শেষভাবে গল্পটি একটু ফল করেছে বলে মনে হতে পারে কারো কারো।
নদীর কথা বা গ্রামীণ জনপদের কথা চিন্তা করলেই আমাদের সবার চোখের সামনে চলে আসে ‘হাজার বছর ধরে’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’- এ ধরনের সিনেমার নাম। আপনি যদি এ সিনেমার সাথে হালদার তুলনা করে সিনেমাটি দেখতে যান তাহলে সিনেমাটি আপনার ভালো নাও লাগতে পারে। কারণ এগুলো কাল্ট সিনেমা। এখানে নদীকে উপজীব্য করে নদী পাড়ের মানুষ ও ভালোবাসার গল্প গড়ে উঠেছে। কিন্তু হালদা সিনেমাতে হয়েছে ঠিক বিপরীত। এখানে একটি নারী চরিত্রকে রূপকভাবে নিয়ে আমাদের নদীর চিত্রটি তুলে ধরা হয়েছে। নদী যে আজ নারীদের মত অসহায় হয়ে যাচ্ছে, নিজের প্রকৃত চরিত্র ভুলে যাচ্ছে তা তুলে ধরা হয়েছে। কারণ হালদা কোন প্রেমের গল্প না, গল্পটি একটি নদীর, নদীর ভিতর থাকা প্রাণিসম্পদের।
সবদিক থেকে বিচার করলে তৌকির আহমেদের অন্য সিনেমার মত ‘হালদা’ও একটি আলাদা ধরনের সিনেমা। অন্য সিনেমার সাথে তুলনা করা ঠিক হবে না। হালদা কে হালদার মত করে দেখুন। ধন্যবাদ।
লেখক : আবদুল্লাহ আল মানী, চলচ্চিত্র সমালোচক
ছবি: Tiger Media